মহার্ঘভাতা নয়, সরাসরি পে-স্কেলের দাবিতে উত্তাল সরকারি কর্মচারী মহল
সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবার চরম রূপ নিতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালের শুরুতে প্রত্যাশিত মহার্ঘভাতা না পাওয়ায় কর্মচারীদের একটি বড় অংশ এখন ‘আর কোনো নাটক’ মেনে নিতে রাজি নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে এখন একটাই দাবি—নতুন পে-স্কেল।
ক্ষোভের মূলে যা আছে
২০১৫ সালের সর্বশেষ পে-স্কেলের পর দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও নতুন কোনো বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ কর্মচারীদের। সম্প্রতি সরকারি কর্মচারী মহলে গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে, সরকার ২০২৬ সাল নাগাদ নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু কর্মচারীদের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিলম্বিত কোনো সিদ্ধান্ত বা ‘উদ্ভট’ কোনো আশ্বাস তারা আর মেনে নেবেন না।
কর্মচারী নেতা মাহমুদুল হাসান এক কড়া বার্তায় জানিয়েছেন:
“কোনো উদ্ভট সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে না। ২০২৫ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে মহার্ঘভাতা চেয়েছিলাম, তখন দেওয়া হয়নি। এখন ২০২৬ সালে এসে কোনো নাটক করলে তা কর্মচারীরা মেনে নেবে না। এখন পে-স্কেল ছাড়া আর কোনো কিছুতেই কর্মচারীদের থামানো যাবে না।”
বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের এই অনড় অবস্থানের পেছনে তিনটি প্রধান কারণ কাজ করছে:
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি: গত কয়েক বছরে মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকায় বর্তমান বেতনে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়া: ২০২৫ সালের শুরু থেকে মহার্ঘভাতার জোরালো দাবি থাকলেও তা উপেক্ষিত হওয়ায় সরকারের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
সময়ের ব্যবধান: সাধারণত ৫ বছর পরপর পে-স্কেল হওয়ার কথা থাকলেও এবার প্রায় এক দশক পার হতে চলেছে, যা কর্মচারীদের মধ্যে বঞ্চনার বোধ তৈরি করেছে।
আন্দোলনের ইঙ্গিত
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকার যদি দ্রুত নতুন পে-স্কেল ঘোষণা বা বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে সচিবালয়সহ সারাদেশে প্রশাসনিক স্থবিরতা তৈরি হতে পারে। নিম্নধাপের কর্মচারীরা ইতিমধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। তাদের দাবি, কোনো ‘অ্যাড-হক’ ভিত্তিক ভাতা নয়, বরং স্থায়ী ও সম্মানজনক বেতন কাঠামোই এখন একমাত্র সমাধান।
সরকারি কর্মচারীরা চায় কি?
সরকারি কর্মচারীদের বর্তমান ক্ষোভ এবং বিভিন্ন সংগঠনের দাবি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের চাওয়া এখন আর কেবল ছোটখাটো কোনো ভাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দীর্ঘ সময় ধরে নতুন বেতন কাঠামো না হওয়ায় তাদের দাবিগুলো এখন অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট এবং জোরালো।
সরকারি কর্মচারীদের প্রধান চাওয়াগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. নতুন পে-স্কেল (১০ম পে-কমিশন)
কর্মচারীদের প্রধান দাবি হলো অবিলম্বে ১০ম পে-কমিশন গঠন করে নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করা। ২০১৫ সালের পর আর কোনো পে-স্কেল না হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির বাজারে বর্তমান বেতনকে তারা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে করছেন। তাদের দাবি, প্রতি ৫ বছর অন্তর পে-স্কেল প্রদানের যে প্রথা ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. মহার্ঘভাতা (অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা)
যেহেতু নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, তাই কর্মচারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ৫০% মহার্ঘভাতা দাবি করছেন। বিশেষ করে ২০২৫ সালের শুরু থেকেই এই দাবিটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে।
৩. বেতন বৈষম্য নিরসন
সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড রয়েছে, যার ফলে উচ্চপদস্থ এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বেতনের ব্যবধান আকাশচুম্বী। কর্মচারীরা চান:
গ্রেড সংখ্যা কমিয়ে আনা (যেমন: ১০টি গ্রেডে নামিয়ে আনা)।
নিচের দিকের গ্রেডগুলোর বেতন কাঠামো সম্মানজনক হারে বৃদ্ধি করা।
৪. নবম পে-স্কেল পর্যন্ত টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনঃপ্রবর্তন
আগে কর্মচারীরা নির্দিষ্ট সময় পর পর ‘টাইম স্কেল’ ও ‘সিলেকশন গ্রেড’ পেতেন, যা ২০১৫ সালের পে-স্কেলে বাতিল করা হয়েছিল। এটি পুনরায় চালু করা কর্মচারীদের অন্যতম বড় দাবি, যাতে পদোন্নতি না হলেও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত হয়।
৫. বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ রেশন ও ভাতা
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে কর্মচারীরা সশস্ত্র বাহিনীর মতো রেশন সুবিধা অথবা বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন।
৬. আউটসোর্সিং প্রথা বিলোপ
চাকরিতে ‘আউটসোর্সিং’ বা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ বন্ধ করে শূন্য পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগের দাবিও এখন বেশ জোরালো।
সারসংক্ষেপ: আপনার উল্লিখিত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, কর্মচারীরা এখন আর কোনো ‘আশ্বাস’ বা ‘বিলম্বিত সিদ্ধান্ত’ মানতে নারাজ। তাদের মূল কথা হলো—২০২৫ সাল থেকে যে আর্থিক সংকটে তারা আছেন, তার সমাধান ২০২৬ সালের কোনো “নাটক” বা দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমে হবে না; বরং সরাসরি পে-স্কেল ঘোষণা করতে হবে।

