বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা ২০২৫ । কোম্পানির একাউটেন্ট পদে গত ২০ বছরেও বেতন বাড়েনি?
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত ২০২৫ সালে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের হিসাবরক্ষক (অ্যাকাউন্টেন্ট) পদের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এসেছে। আপনার প্রশ্নটি একটি নির্দিষ্ট সমস্যাকে নির্দেশ করছে— “গত ২০ বছরেও বেতন বাড়েনি।” এটি একটি বিরল এবং অস্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত, মূল্যস্ফীতি এবং কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বেতন বৃদ্ধি হয়। যদি আপনার পরিচিত কোনো অ্যাকাউন্টেটের ক্ষেত্রে এটি সত্য হয়, তবে এর কিছু কারণ থাকতে পারে এবং কিছু সম্ভাব্য সমাধানও রয়েছে– বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা ২০২৫
বেতন না বাড়ার সম্ভাব্য কারণ কি? প্রতিষ্ঠান যদি ছোট বা মাঝারি আকারের হয় এবং গত ২০ বছরে তাদের আয় বা প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ না হয়, তবে কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা তাদের পক্ষে কঠিন হতে পারে। যদি অ্যাকাউন্টেট তার কাজের পরিধি বা দক্ষতা ২০ বছর ধরে একই রাখেন এবং নতুন কোনো প্রযুক্তি বা হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির সাথে নিজেকে আপগ্রেড না করেন, তবে তার বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বর্তমানে হিসাবরক্ষণের কাজ অনেক স্বয়ংক্রিয় (automated) হয়ে গেছে। নতুন সফটওয়্যার, এআই টুলস, এবং ইআরপি সিস্টেমের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে শুধুমাত্র গতানুগতিক হিসাবরক্ষণকারী পেশাজীবীর চাহিদা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে হিসাবরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাজীবীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এর ফলে বাজারে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির চাপ কম থাকে। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন সঠিকভাবে করে না এবং শুধুমাত্র পুরোনো কর্মীদের ধরে রাখার জন্য ন্যূনতম বেতন দেয়।
২০২৫ সালে বেসরকারি হিসাবরক্ষকদের বেতন-ভাতা কেমন? ২০২৫ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে একজন হিসাবরক্ষকের বেতন সাধারণত তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রতিষ্ঠানের আকারের ওপর নির্ভর করে। প্রবেশ-স্তরের (Entry-level) হিসাবরক্ষক: সাধারণত ১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। অভিজ্ঞ (Experienced) হিসাবরক্ষক: ৫ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে ৩০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত বা তার বেশি বেতন হতে পারে। সিনিয়র অ্যাকাউন্টেট/ম্যানেজার: ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা এবং প্রতিষ্ঠানের বড় দায়িত্ব থাকলে ৭০,০০০ টাকা থেকে ১,৫০,০০০ টাকা বা তারও বেশি বেতন পেয়ে থাকেন।
এখনকার বাজারে মাস্টার্স পাশ করে ১৫০০০ টাকা বেতনে চাকরি? মাস্টার্স পাস করে ১৫,০০০ টাকা বেতনে চাকরি, এই প্রশ্নটি বর্তমান চাকরির বাজারের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হয়েও এমন কম বেতনে চাকরি পাওয়ার কিছু কারণ আছে। এই পরিস্থিতিটি কেন হচ্ছে এবং এর সমাধানের জন্য কী করা যেতে পারে। মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের ১৫,০০০ টাকা বেতনে চাকরির কারণ চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতা বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পাস করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং তুলনামূলকভাবে মানসম্মত চাকরির সংখ্যা কম হওয়ায় বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান কম বেতনেও উচ্চশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, শিক্ষাগত যোগ্যতা (মাস্টার্স ডিগ্রি) থাকলেও চাকরিক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতা (যেমন – কম্পিউটার দক্ষতা, যোগাযোগ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ইত্যাদি) বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান (টেকনিক্যাল স্কিল) যথেষ্ট থাকে না। তাই, প্রতিষ্ঠানগুলো কম বেতনে নিয়োগ দিয়ে কর্মীদের নিজ খরচে প্রশিক্ষণ দেয়। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সময়ই শিল্পক্ষেত্রের বর্তমান চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ফলে, ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা আধুনিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না। বেসরকারি খাতে সরকারি খাতের মতো কোনো নির্দিষ্ট বেতন স্কেল নেই। ছোট ও মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের লাভ এবং সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে বেতন নির্ধারণ করে। তাই অনেক কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম বেতন দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বস অলওয়েজ ইজ রাইট/ যে কোন সময় কোম্পানি বলে দিতে পারে যে, কাল থেকে আপনার আর আসার দরকার নেই
বাস্তবে, বেতন অনেক কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন: দেশীয় ছোট ও মাঝারি আকারের কোম্পানিগুলোর তুলনায় বহুজাতিক এবং বড় দেশীয় কোম্পানিগুলো বেশি বেতন দেয়। ব্যাংকিং, টেলিকম, তথ্যপ্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতের বেতন কাঠামো তুলনামূলকভাবে বেশি হয়ে থাকে।প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি পেশাদারী সনদ (যেমন CA, ACCA) ও বিশেষ কারিগরি দক্ষতা থাকলে বেতন অনেক বেশি হয়। ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে জীবনযাত্রার খরচ বেশি হওয়ায় বেতনও বেশি হয়।
Caption: Company job Temporary
বেসরকারি চাকরির শুরুতে বেতন খুবই কম ২০২৫ । এন্ট্রি লেভেলে এত কম বেতনে চাকরির কারণে গ্র্যাজুয়েটরা কি কি সমস্যায় ভোগে? এন্ট্রি লেভেলে কম বেতনে চাকরির কারণে গ্র্যাজুয়েটরা নানা ধরনের সমস্যায় ভোগেন, যা তাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পেশাদারী জীবন পর্যন্ত প্রভাবিত করে। এই সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে তাদের অর্থনৈতিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
- জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে কষ্ট: একজন গ্র্যাজুয়েট যখন ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন, তখন তার পক্ষে বর্তমান বাজারে নিজের জীবনযাত্রার ন্যূনতম ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যদি তাকে বাসা ভাড়া, খাবার, যাতায়াত এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত খরচ চালাতে হয়।
- ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা: অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শিক্ষা ঋণ নিয়ে থাকেন। কম বেতনের কারণে তারা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, যা তাদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে।
- ভবিষ্যৎ সঞ্চয় না থাকা: কম বেতনে চাকরি করলে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে জরুরি প্রয়োজনে বা ভবিষ্যতের জন্য কোনো বিনিয়োগের সুযোগ থাকে না, যা তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কমিয়ে দেয়।
- মানসিক চাপ ও হতাশা: উচ্চশিক্ষা লাভ করার পরও কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হলে অনেক গ্র্যাজুয়েট মানসিক চাপ ও হতাশায় ভোগেন। তারা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং মনে করেন তাদের মেধা ও শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।
- সামাজিক মর্যাদা কমে যাওয়া: সমাজে এখনো ভালো বেতনের চাকরিকে সফলতার মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয়। কম বেতনে চাকরি করার কারণে অনেক গ্র্যাজুয়েট সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে বা বন্ধুমহলে তাদের কাজের ব্যাপারে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
- পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা: পরিবার অনেক সময় সন্তানের উচ্চশিক্ষা লাভের পেছনে প্রচুর অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে। গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে ভালো আয়ের প্রত্যাশা থাকে। কম বেতনে চাকরি করলে তারা পরিবারের এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন না, যা তাদের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি করে।
- দক্ষতা উন্নয়নে বাধা: কম বেতনের কারণে অনেক গ্র্যাজুয়েট তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, কোর্স বা সার্টিফিকেশনে বিনিয়োগ করতে পারেন না। এর ফলে তারা কর্মজীবনে আরও উন্নত পদ ও ভালো বেতনের চাকরি পাওয়ার সুযোগ হারান।
- কাজের প্রতি অনীহা: কম বেতন পেলে অনেক কর্মী তাদের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে তারা মন দিয়ে কাজ করেন না এবং তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
- ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন: কম বেতনে চাকরি শুরু করলে অনেকেই ভালো বেতনের সন্ধানে ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন করতে থাকেন। এতে তাদের কর্মজীবনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
এন্ট্রি লেভেল পদে বেতন বাড়ানোর সম্ভাব্য সমাধান কি?
যদি কোনো অ্যাকাউন্টেটের বেতন ২০ বছর ধরে না বেড়ে থাকে, তবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়ে হিসাবরক্ষণ সফটওয়্যার (যেমন Tally, QuickBooks, SAP) এবং ডেটা অ্যানালাইসিস টুলস (যেমন Microsoft Excel) এর উপর দক্ষতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। নতুন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে একজন হিসাবরক্ষক তার নিজের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারেন। বিভিন্ন পেশাদারী সার্টিফিকেশন (যেমন CA, CMA, ACCA) অর্জন করলে বেতনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। যদি বর্তমান প্রতিষ্ঠানে বেতন বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা না থাকে, তবে একই দক্ষতার জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আরও ভালো বেতনের সুযোগ খুঁজতে হবে। একজন কর্মীর উচিত তার কর্মদক্ষতা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার অবদানের বিষয়ে তথ্য-উপাত্তসহ সরাসরি কর্তৃপক্ষের সাথে বেতন বৃদ্ধির জন্য আলোচনা করা। শুধুমাত্র হিসাবরক্ষণ নয়, বরং আর্থিক বিশ্লেষণ (Financial Analysis), ট্যাক্স পরিকল্পনা, বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো ক্ষেত্রেও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। বর্তমানে, বেসরকারি খাতে কর্মজীবীদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে বাজার পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর। যেহেতু প্রযুক্তির কারণে অনেক পুরাতন কাজ স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে, তাই যারা নতুন দক্ষতা অর্জন করছেন, তাদের বেতন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা পুরোনো কাজ এবং দক্ষতা নিয়েই রয়েছেন, তাদের বেতন বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কম।
বেসরকারি খাতে বিভিন্ন পদের বেতন-ভাতার তালিকা (২০২৫)