থাইরয়েড সমস্যার কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা
মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন নিয়ন্ত্রণকারী গ্রন্থিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো থাইরয়েড গ্রন্থি। এটি ঘাড়ের সামনের অংশে অবস্থিত একটি প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি, যা শরীরের বিপাকক্রিয়া, শক্তি উৎপাদন, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
যখন এই গ্রন্থিটি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন দেখা দেয় থাইরয়েড সমস্যা যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে খুবই সাধারণ একটি হরমোনজনিত রোগ।
এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব থাইরয়েড সমস্যার কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে।
থাইরয়েড কী এবং এর কাজ কী?
থাইরয়েড হলো একটি ছোট গ্রন্থি যা দুটি হরমোন তৈরি করেঃ
- T3 (Triiodothyronine)
- T4 (Thyroxine)
এই হরমোনগুলো শরীরের প্রতিটি কোষে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে এবং বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে পিটুইটারি গ্রন্থি যা Thyroid Stimulating Hormone নিঃসরণ করে।
যখন থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন হয় হাইপারথাইরয়েডিজম এবং যখন কমে যায়, তখন হয় হাইপোথাইরয়েডিজম।
থাইরয়েড সমস্যার প্রকারভেদ
- হাইপোথাইরয়েডিজমঃ
থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শরীরের বিপাকক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। - হাইপারথাইরয়েডিজমঃ
- থাইরয়েড হরমোন অতিরিক্ত উৎপাদন করলে শরীরের বিপাকক্রিয়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
- গয়টারঃ
থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া বা বড় হয়ে যাওয়া অবস্থাকে বলে। - থাইরয়েড নডিউলঃ
থাইরয়েডে ছোট ছোট গুটি তৈরি হয়, যা কখনো কখনো ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। - থাইরয়েড ক্যান্সারঃ
থাইরয়েড কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে তা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
থাইরয়েড সমস্যার কারণ
থাইরয়েডের সমস্যা হওয়ার কারণ নানা রকম। নিচে কয়েকটি সাধারণ কারণ দেওয়া হলোঃ
- Autoimmune রোগঃ যেমন হাইপারথাইরয়েডিজমে ও হাইপোথাইরয়েডিজমে।
- আয়োডিনের অভাবঃ আয়োডিন কম গ্রহণ করলে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হয়।
- জেনেটিক কারণঃ পারিবারিকভাবে থাইরয়েড রোগের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ কিছু ওষুধ যেমন lithium বা amiodarone থাইরয়েডের কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে।
- রেডিয়েশন থেরাপিঃ ঘাড় বা মাথায় রেডিয়েশন নেওয়ার ফলে থাইরয়েড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- মানসিক চাপ ও জীবনযাত্রাঃ দীর্ঘদিন মানসিক চাপ, অনিয়মিত ঘুম, ও অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়াও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণ
থাইরয়েড সমস্যার ধরন অনুযায়ী উপসর্গগুলো ভিন্ন হতে পারে। নিচে আলাদা করে দেওয়া হলোঃ
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণঃ
- সবসময় ক্লান্ত লাগা ও ঘুম ঘুম ভাব।
- ওজন বৃদ্ধি।
- ত্বক শুষ্ক ও চুল পড়া।
- কোষ্ঠকাঠিন্য।
- ঠান্ডা সহ্য না হওয়া।
- বিষণ্নতা বা মনোযোগে ঘাটতি।
- মাসিক অনিয়ম বা বন্ধ্যাত্ব সমস্যা।
হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণঃ
- ওজন কমে যাওয়া।
- অতিরিক্ত ঘাম ও গরম সহ্য না হওয়া।
- হার্টবিট বেড়ে যাওয়া বা অনিয়মিত স্পন্দন।
- হাত কাঁপা।
- উদ্বেগ বা অতিরিক্ত নার্ভাসনেস।
- ঘুমের সমস্যা।
- চোখ ফুলে যাওয়া বা চোখে ব্যথা।
যদি উপরোক্ত কোনো উপসর্গ দীর্ঘদিন ধরে থাকে, তাহলে অবশ্যই একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ঢাকা এর পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়
থাইরয়েড সমস্যা নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক সাধারণত নিচের পরীক্ষাগুলো করে থাকেনঃ
- রক্ত পরীক্ষাঃ
- TSH
- T3 ও T4 লেভেল
- Anti-TPO antibody
- আল্ট্রাসনোগ্রাফিঃ
থাইরয়েডের আকার, নডিউল বা টিউমার আছে কিনা তা বোঝা যায়। - থাইরয়েড স্ক্যানঃ
থাইরয়েড কতটা সক্রিয়ভাবে হরমোন তৈরি করছে তা নির্ণয় করা হয়। - ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশনঃ
থাইরয়েডে গুটি থাকলে তা ক্যান্সারজনিত কিনা যাচাইয়ের জন্য FNAC করা হয়।
থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা
থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা নির্ভর করে কোন ধরনের সমস্যা হয়েছে তার ওপর। সাধারণত নিচের চিকিৎসাগুলো অনুসরণ করা হয়ঃ
১. হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসাঃ
- লেভোথাইরক্সিন নামক হরমোন রিপ্লেসমেন্ট ওষুধ দেওয়া হয়, যা নিয়মিত গ্রহণ করতে হয়।
- খাদ্যাভ্যাসে আয়োডিনযুক্ত লবণ, সামুদ্রিক মাছ ও ডিম অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
২. হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসাঃ
- Antithyroid Drugs যেমন Methimazole বা Propylthiouracil দেওয়া হয়।
- কখনো কখনো Radioactive Iodine Therapy ব্যবহার করা হয়।
- কিছু ক্ষেত্রে Surgery (Thyroidectomy) প্রয়োজন হতে পারে।
৩. থাইরয়েড নডিউল বা ক্যান্সারের চিকিৎসাঃ
- নডিউল সন্দেহজনক হলে সার্জারি করে তা অপসারণ করা হয়।
- ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়।
থাইরয়েড সমস্যায় জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্য ও জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবেঃ
- পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা।
- আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুধ খাওয়া।
- সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ও হোল গ্রেইন অন্তর্ভুক্ত করা।
উপসংহার
থাইরয়েড সমস্যা একটি সাধারণ হলেও অবহেলা করলে এটি গুরুতর হরমোনজনিত রোগে পরিণত হতে পারে। সঠিক সময়ে নির্ণয় ও নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যদি আপনার ক্লান্তি, ওজন পরিবর্তন, মানসিক অস্থিরতা বা ঘাড়ে ফোলা দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ নিন।

