চরম বৈষম্যের শিকার নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা: বেতন কাঠামোতে ‘ক্ষয়রাতি বৃদ্ধি’ ও শীর্ষ পদে আকাশচুম্বী বেতন পার্থক্য?
বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান বেতন কাঠামো, বিশেষ করে ২০১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেল, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের মধ্যে এক বিশাল বেতন বৈষম্যের দেয়াল তৈরি করেছে। সরকারের সর্বনিন্ম ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত ১:১০ হলেও, বিভিন্ন গ্রেডে বেতনের পার্থক্য সমানুপাতিক হারে ক্রমবর্ধমান না হওয়ায় এই বৈষম্য এখন তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কর্মচারী সংগঠনগুলো একে ‘ক্ষয়রাতি বৃদ্ধি’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে বৈষম্য নিরসনের দাবি জানাচ্ছে।
অসামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন বৃদ্ধির চিত্র
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সরকারি বেতন কাঠামোর নিম্ন গ্রেডগুলোতে বেতনের পার্থক্য অত্যন্ত নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ, পে-স্কেল ২০১৫ ঘেঁটে দেখা যায়— ২০তম ও ১৯তম গ্রেডের মধ্যে মূল বেতনের পার্থক্য মাত্র ২৫০ টাকা, এবং ১৭তম ও ১৮তম গ্রেডের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২০০ টাকা। ১২তম ও ১৩তম গ্রেডের পার্থক্যও প্রায় ৩০০ টাকার মতো। এই সামান্য বৃদ্ধিকে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা ‘খয়রাতি’ বা নামমাত্র বৃদ্ধি হিসেবে দেখছেন।
অন্যদিকে, উচ্চ গ্রেডগুলোতে বেতনের পার্থক্য বহু গুণ বেশি। যেমন:
- ১ম গ্রেডের (সচিব) নির্ধারিত মূল বেতন ৭৮,০০০ টাকা।
- ১১তম গ্রেডের প্রারম্ভিক মূল বেতন ১২,৫০০ টাকা।
এই দুটি গ্রেডের মধ্যে শুধুমাত্র মূল বেতনের পার্থক্যই প্রায় ৬৫,৫০০ টাকা। কর্মচারী পক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা যোগ করলে এই পার্থক্য দুই লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, বেতন কাঠামোর নিম্ন ধাপে একটি গ্রেড থেকে অন্য গ্রেডে যেতে যেখানে কর্মীদের মাত্র কয়েকশ’ টাকা বেশি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে উচ্চ গ্রেডে একই দূরত্বে হাজার হাজার টাকার পার্থক্য তৈরি করা হচ্ছে।
‘ইচ্ছা’র অভাব এবং বাজেট বিতর্ক
নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা মনে করছেন, এই বৈষম্যের মূল কারণ অর্থের অভাব নয়, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহলের ইচ্ছার অভাব। তাঁদের যুক্তি, ২০১৫ সালের পর দেশের জাতীয় বাজেট কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেলেও, বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের দাবি, যদি সমানুপাতিক (কম্পাউন্ড রেট) হারে বেতন বৃদ্ধি করা হতো, তাহলে এমনিতেই ক্রমবর্ধমান হারে বেতন বৃদ্ধি পেত এবং এই বিশাল ব্যবধান তৈরি হতো না। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:৮ বা ১:১০-এর মধ্যে রাখার যুক্তি থাকলেও, বেতন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কেন এমন ‘অগোছালো’ যেখানে নিম্ন গ্রেডগুলি প্রায় উপেক্ষিত।
তৃণমূল কর্মচারীর যোগ্যতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
একসময় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত পদের জন্য বর্তমান যুগে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) বা বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী প্রার্থীরাও নিয়োগ পাচ্ছেন। কম্পিউটার অপারেটরের মতো পদেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসছেন। অথচ বেতন কাঠামোতে তাদের কাজের গুরুত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
কর্মচারী সংগঠনগুলোর বক্তব্য, বড় কর্মকর্তারা ‘দেশ চালান’ বলে সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করেন— এই যুক্তি এখন অচল। মাঠপর্যায়ের একজন কর্মচারী ছাড়া প্রশাসনের তৃণমূল স্তরের কাজ চালানো অসম্ভব। মূলত প্রশাসনের ক্ষমতা যাঁদের হাতে থাকে, তাঁরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বেতন কাঠামো তৈরি করেন বলেই এই বৈষম্য টিকে আছে। এটিকে অনেকে ‘যেই লঙ্কায় যায়, সেই রাবণ হয়’—এই প্রবাদের মাধ্যমে ক্ষমতার কাঠামোগত দুর্বলতাকেই তুলে ধরছেন।
১১ থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের সংগঠনগুলো অভিন্ন নিয়োগ বিধি, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালসহ আট দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান বেতন বৈষম্য দূর করে গ্রেড অনুযায়ী বেতন স্কেলের পার্থক্য সমহারে নির্ধারণ করাই এখন তাঁদের প্রধান দাবি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এই দীর্ঘদিনের বেতন বৈষম্য নিরসন করা জরুরি।
৯ম পে-স্কেল (সমান ১০% ব্যবধানে বৈষম্যহীন প্রকৃত গ্রেডিং কাঠামো)
সরকারি চাকরির গ্রেডিং কাঠামো নিয়ে আপনার যুক্তিসঙ্গত মতামত এবং আপনি যে ধরনের তুলনা করতে চাইছেন, তার ভিত্তিতে একটি সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করা হলো।
৯ম পে-স্কেলের প্রস্তাবনায় অসঙ্গতি: ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের শেষ জীবনের বেতন কাঠামো উপেক্ষিত
সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত ৯ম পে-স্কেলের কাঠামো নির্ধারণে আবারও বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। বেতন স্কেলের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য যখন ১ম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতনের (১,২২,৩১৮/- টাকা) সাথে ২০তম গ্রেডের সর্বনিম্ন বেতনের (২০,০০০/- টাকা) তুলনা করা হচ্ছে, তখন সরকারের সর্বস্তরের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ধরনের তুলনা বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ বেমানান এবং কর্মচারীদের মধ্যে বিদ্যমান আর্থিক বৈষম্যকে আরও প্রকট করবে।
বাস্তবসম্মত তুলনা কেন জরুরি?
সাধারণত, সরকারি চাকরিতে প্রথম গ্রেড (গ্রেড-১) কোনো প্রবেশ পদ (Entry-level) নয়। এটি একজন কর্মকর্তা তার দীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে পদোন্নতি ও দক্ষতা প্রমাণের মাধ্যমে অর্জন করেন। অন্যদিকে, ২০তম গ্রেডে একজন কর্মচারী তার কর্মজীবন শুরু করেন।
তুলনার ক্ষেত্রে, ১ম গ্রেডের সর্বোচ্চ স্কেলের বেতনের (১,২২,৩১৮/- টাকা) বিপরীতে ২০তম গ্রেডের শেষ ধাপের বেতনের হিসাব করা উচিত ছিল। বর্তমান (২০১৫) বেতন স্কেল অনুযায়ী ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা চাকরির শেষ প্রান্তে গিয়ে প্রায় ২০,০১০/- টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পেয়ে থাকেন। প্রস্তাবিত কাঠামোতে এই বেতন আরও বেশি হবে।
তবে, যে নতুন কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে ২০তম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন () এবং ৯ম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন () এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান রাখা হয়েছে।
যে বৈষম্য দূর করতে হবে
চাকরিজীবীদের দাবি, যখন একটি নতুন বেতন কাঠামো তৈরি করা হয়, তখন নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের সারা জীবনের অর্জিত আর্থিক সুবিধাগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
- গ্রেড-১ বনাম গ্রেড-৯: সরকারি চাকরিতে ৯ম গ্রেড হলো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার প্রবেশ পদ। এই পদ থেকে পদোন্নতি পেয়েই একজন কর্মকর্তা ১ম গ্রেডে পৌঁছাতে পারেন। ফলে, ৯ম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতনের সাথে ১ম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতনের তুলনা করাই অসংগতিপূর্ণ।
- ২০তম গ্রেডের বাস্তবতা: একজন ২০তম গ্রেডের কর্মচারীও তার দীর্ঘ কর্মজীবনের শেষে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছান। তাঁরও পদোন্নতি বা উচ্চতর স্কেল প্রাপ্তির মাধ্যমে বেতন বাড়ে। তিনি কর্মজীবনের শেষে যদি ৫০-৬০ হাজার টাকার কাছাকাছি মূল বেতন না পান, তাহলে নতুন বেতন স্কেল বৈষম্য আরও বাড়াবে।
- অনুপাত নির্ধারণ: সরকারি বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ (গ্রেড-১) ও সর্বনিম্ন (গ্রেড-২০) বেতনের অনুপাত নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনুপাত ১:৮ থেকে ১:১০-এর মধ্যে থাকা উচিত। কিন্তু প্রস্তাবিত কাঠামোতে যদি ২০তম গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতনের (২০,০০০/-) সাথে ১ম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতনের (১,২২,৩১৮/-) তুলনা করা হয়, তাহলে অনুপাতটি ১:৬-এর কাছাকাছি থাকে, যা দেখে মনে হতে পারে বৈষম্য কমেছে। তবে, ২০তম গ্রেডের একজন অভিজ্ঞ কর্মচারীর সর্বোচ্চ বেতনের সাথে এই অনুপাত তুলনা করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে— বেতন কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হোক যেখানে শুধুমাত্র প্রবেশ পদের ভিত্তিতে নয়, বরং চাকরির শেষ সময়ের ২০তম গ্রেড ও ৯ম গ্রেডের বেতনের মধ্যে একটি যৌক্তিক ও বৈষম্যহীন ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়। এটি না হলে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের প্রতি অবিচার করা হবে এবং নতুন পে-স্কেলের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ বৈষম্যহীন একটি কাঠামো তৈরি করা, ব্যাহত হবে।

