টিন (TIN) সার্টিফিকেট বাতিল করবেন যেভাবে: জেনে নিন প্রয়োজনীয় শর্ত ও প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের নাগরিকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে যেমন—গাড়ি কেনা, ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যাংক ঋণের জন্য ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) বা টিন সনদ গ্রহণ করতে হয়। তবে অনেক সময় করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও আইনি বাধ্যবাধকতায় এই সনদ নিতে হয়। পরবর্তীতে এই সনদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে বা আয় করসীমার নিচে নেমে এলে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তা বাতিলের সুযোগ রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
টিন বাতিলের পূর্বশর্ত
সরকার সম্প্রতি টিন নিবন্ধন বাতিলের জন্য ছয়টি বিশেষ শর্ত নির্ধারণ করেছে। করদাতারা কেবল তখনই বাতিলের আবেদন করতে পারবেন যখন: ১. করদাতার রিটার্ন দাখিলের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ২. করদাতা মৃত্যুবরণ করলে বা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হলে। ৩. স্থায়ীভাবে দেশত্যাগ করলে এবং বাংলাদেশে আয়ের কোনো উৎস না থাকলে। ৪. ভুল তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করলে বা একাধিক নিবন্ধন থাকলে। ৫. আইনি মর্যাদা পরিবর্তন হলে। ৬. অন্য কোনো আইনানুগ কারণ থাকলে।
কারা আবেদন করতে পারবেন?
মূলত যাদের বার্ষিক আয় করযোগ্য আয়ের সীমার নিচে, তারাই বাতিলের আবেদন করতে পারেন। ২০২৪-২৫ অর্থ-বছরের হিসেবে সাধারণ করদাতার আয় বছরে ৩,৭৫,০০০ টাকার নিচে হলে এবং নারী বা ৬৫ ঊর্ধ্বদের ক্ষেত্রে ৪,৫০,০০০ টাকার নিচে হলে তারা বাতিলের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। এছাড়া প্রতিবন্ধী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই সীমা আরও বেশি।
বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
আবেদন করার আগে করদাতাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করতে হবে:
বর্তমান টিন সার্টিফিকেটের প্রিন্ট কপি।
জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) ফটোকপি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: টানা তিন অর্থ-বছরের ‘শূন্য রিটার্ন’ (Zero Return) দাখিলের প্রাপ্তি স্বীকার পত্রের কপি।
আবেদন পদ্ধতি
টিন সার্টিফিকেট বাতিলের প্রক্রিয়াটি সরাসরি অনলাইনে সম্পন্ন করা যায় না, এর জন্য সশরীরে কর অফিসে যেতে হয়:
টানা তিন বছর শূন্য রিটার্ন: আবেদনকারীকে টানা তিন বছর তার আয় যে করসীমার নিচে, তা উল্লেখ করে রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং প্রাপ্তি স্বীকার পত্র সংগ্রহ করতে হবে।
আবেদনপত্র জমা: তৃতীয় বছর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট কর সার্কেলের উপকর কমিশনার বরাবর লিখিত আবেদন করতে হবে। আবেদনপত্রে কেন টিন বাতিল করতে চান, তার সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করতে হবে।
প্রতিনিধি মারফত আবেদন: করদাতা নিজে উপস্থিত হতে না পারলে তার প্রতিনিধির মাধ্যমেও আবেদনপত্র জমা দিতে পারবেন।
খরচ ও পরবর্তী ধাপ
টিন সার্টিফিকেট বাতিলের জন্য সরকারকে কোনো ফি প্রদান করতে হয় না; এই সেবা সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক। আবেদন জমা দেওয়ার পর উপকর কমিশনারের কার্যালয় থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। তথ্যের সত্যতা সাপেক্ষে ফাইলটি চূড়ান্তভাবে নথিভুক্ত (Closed) করা হবে এবং টিনটি বাতিল হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপ্রয়োজনীয় টিন সার্টিফিকেট বয়ে বেড়ানো অনেক সময় আইনি জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই আয় না থাকলে বা প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সরকারি নিয়ম মেনে তা বাতিল করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
টিন (TIN) সার্টিফিকেট বাতিলের নমুনা আবেদনপত্র
তারিখ: [আজকের তারিখ লিখুন]
বরাবর, উপকর কমিশনার কর সার্কেল- [আপনার সার্কেল নম্বর লিখুন, যেমন: ১২১] কর অঞ্চল- [আপনার কর অঞ্চলের নাম লিখুন, যেমন: ঢাকা-১০] বাংলাদেশ।
বিষয়: টিআইএন (TIN) নিবন্ধন বাতিলের জন্য আবেদন।
মহোদয়, বিনীত নিবেদন এই যে, আমি [আপনার নাম], নিম্নস্বাক্ষরকারী আপনার কর অঞ্চলের একজন করদাতা। আমার টিআইএন নম্বর: [আপনার ১২ ডিজিটের টিন নম্বরটি লিখুন]।
আমি বিগত [যে কারণে টিন করেছিলেন, যেমন: ক্রেডিট কার্ড/ট্রেড লাইসেন্স] প্রয়োজনে উক্ত টিন নিবন্ধনটি করেছিলাম। বর্তমানে আমার বার্ষিক আয় করযোগ্য আয়ের সীমার নিচে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আমার করযোগ্য আয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। উল্লেখ্য যে, আমি বিগত টানা তিন অর্থ-বছর [যেমন: ২০২১-২২, ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪] নিয়মিতভাবে ‘শূন্য রিটার্ন’ দাখিল করে আসছি। বর্তমানে উক্ত টিন সনদটির আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই।
আবেদনকারীর তথ্যাদি:
নাম:
পিতা/স্বামীর নাম:
বর্তমান ঠিকানা:
মোবাইল নম্বর:
অতএব, মহোদয়ের নিকট বিনীত প্রার্থনা এই যে, আমার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সংযুক্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই পূর্বক আমার টিআইএন (TIN) নিবন্ধনটি বাতিল করতে আপনার সদয় মর্জি হয়।
বিনীত নিবেদক,
(স্বাক্ষর)
[আপনার নাম] টিআইএন: [আপনার টিন নম্বর]
আবেদনের সাথে যা যা সংযুক্ত করবেন:
আপনার টিআইএন (TIN) সার্টিফিকেটের ফটোকপি।
জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) ফটোকপি।
গত ৩ বছরের রিটার্ন দাখিলের প্রাপ্তি স্বীকার পত্রের (Acknowledgement Slip) ফটোকপি।
যদি কোনো নির্দিষ্ট কারণে (যেমন: ব্যবসা বন্ধ বা বিদেশে গমন) বাতিল করতে চান, তবে তার স্বপক্ষে প্রমাণপত্র (যেমন: ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের কপি বা পাসপোর্টের কপি)।
পরবর্তী ধাপ:
এই আবেদনপত্রটি আপনার কর সার্কেল অফিসে গিয়ে জমা দিন।
জমা দেওয়ার সময় অবশ্যই একটি রিসিভ কপি (আবেদনপত্রের ফটোকপিতে সিল দিয়ে রাখা) নিজের কাছে রাখবেন।
জমা দেওয়ার কয়েকদিন পর সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে আপনার ফাইলটি যাচাই করে বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করবে।

