বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর যুগান্তকারী সংশোধনী ২০২৫ । শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সুবিধা ও ট্রেড ইউনিয়নে নমনীয়তা?
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধনী)-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক সুবিধা বৃদ্ধি এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে নমনীয়তা এনেছে। ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ তারিখ থেকে কার্যকর হওয়া এই সংশোধনীতে উৎসবের ছুটি বৃদ্ধি, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার সম্প্রসারণ এবং সার্ভিস বেনিফিট কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।
🥳 উৎসবের ছুটি বৃদ্ধি
সংশোধনী অনুযায়ী, উৎসবের ছুটি (ধারা-১১৮) ২ দিন বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকরা এখন থেকে ১১ দিনের পরিবর্তে বছরে মোট ১৩ দিন উৎসবের ছুটি ভোগ করবেন।
💼 সার্ভিস বেনিফিটে ব্যাপক পরিবর্তন
শ্রমিক কর্তৃক চাকুরীর অবসান (ধারা-২৭) সংক্রান্ত বিধানে সার্ভিস বেনিফিটের কাঠামোতে বড় পরিবর্তন এসেছে:
৩ বছর পর্যন্ত: এই প্রথম ৩ বছর পর্যন্ত প্রতি বছরের জন্য ৭ দিন করে সার্ভিস বেনিফিটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৩ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত: এই সময়কালের জন্য সার্ভিস বেনিফিট প্রতি বছরে ১৫ দিন করে ধার্য করা হয়েছে (যা পূর্বে ৫ থেকে ৯ বছরের জন্য প্রযোজ্য ছিল)।
১০ বছর বা তদূর্ধ্ব: দীর্ঘকাল ধরে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য প্রতি বছরের জন্য ৩০ দিন করে সার্ভিস বেনিফিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এছাড়াও, শ্রমিক ও মালিকের সংজ্ঞা (ধারা-২ এর ৪৯ ও ৬৫) পরিবর্তন করে শ্রমিকের সংজ্ঞায় কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা আরো স্পষ্ট করা হয়েছে, যার ফলে তাদেরও সার্ভিস বেনিফিট প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো।
🤰 প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার সম্প্রসারণ
শ্রমজীবী মায়েদের জন্য প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সুবিধা পূর্বের ১১২ দিন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১২০ দিন হয়েছে।
🏛️ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে নমনীয়তা
ট্রেড ইউনিয়ন (ধারা ১৭৯) গঠনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ন্যূনতম সংখ্যা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংখ্যার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যার ফলে ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া সহজ হবে। এখন থেকে:
যে প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংখ্যা ২০ – ৩০০ জন, সেখানে ২০ জন শ্রমিকের আবেদনই যথেষ্ট।
প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংখ্যা ৩০০১ বা তদূর্ধ্ব হলেও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য সর্বোচ্চ ৪০০ জন শ্রমিকের আবেদন প্রয়োজন হবে।
🏦 মালিকের জন্য ভবিষ্য তহবিল বাধ্যতামূলক
ভবিষ্য তহবিল (ধারা ২৬৪)-এর অধীনে ভবিষ্য তহবিল বা পেনশন মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইনে এখন থেকে শ্রমিকের প্রদেয় ন্যূনতম ৭% এবং অনধিক ৮% এর সমপরিমাণ অর্থ মালিককে প্রদান করতে হবে।
🗓️ বাৎসরিক ছুটি পুনর্বিন্যাস
বাৎসরিক ছুটি (ধারা ১১৭)-এর বিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন থেকে প্রতি ১৪ দিন কাজের জন্য শ্রমিকরা ১ দিন করে বাৎসরিক ছুটি পাবেন, যা পূর্বের ১৮ দিনের বিধানের চেয়ে শ্রমিকদের পক্ষে বেশি অনুকূল।
এই সংশোধনীগুলো শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের একটি দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শ্রমিকদের দাবী আদায় কি এখন সহজ হবে?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর নতুন সংশোধনীগুলোর ফলে শ্রমিকদের দাবি আদায় এবং সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া এখন তুলনামূলকভাবে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নিম্নে দুটি প্রধান কারণে এটি সহজ হবে বলে বিশ্লেষণ করা হলো:
১. 👥 ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে নমনীয়তা (ধারা ১৭৯)
নতুন সংশোধনীতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এটি শ্রমিকদের জন্য সংগঠিত হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করাকে সহজ করে তুলেছে।
| প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংখ্যা | পূর্বের প্রয়োজনীয়তা | সংশোধনী অনুযায়ী প্রয়োজনীয়তা |
| ২০ – ৩০০ জন | তুলনামূলকভাবে বেশি | ২০ জন |
| ৩০১ – ৫০০ জন | তুলনামূলকভাবে বেশি | ৪০ জন |
| ৩০০১ বা তদূর্ধ্ব | তুলনামূলকভাবে বেশি | ৪০০ জন |
গুরুত্ব: শ্রমিকরা একটি বৈধ এবং স্বীকৃত সংগঠনের মাধ্যমে তাদের মজুরি বৃদ্ধি, উন্নত কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য অধিকারের জন্য সম্মিলিতভাবে দর কষাকষি (Collective Bargaining) করার শক্তিশালী সুযোগ পাবে। এটি বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিগত দাবি আদায়ের চেয়ে অনেক কার্যকর।
২. ✅ সংজ্ঞার পরিবর্তন ও সুবিধা বৃদ্ধি
শ্রমিক ও মালিকের সংজ্ঞা (ধারা-২ এর ৪৯ ও ৬৫): শ্রমিক হিসেবে কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি স্পষ্ট করার ফলে এই স্তরের কর্মীরাও এখন সার্ভিস বেনিফিটসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের আশ্রয় নিতে পারবে।
সার্ভিস বেনিফিট (ধারা-২৭): চাকরিচ্যুতির পর প্রাপ্ত বেনিফিটের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকরা আর্থিকভাবে আরও সুরক্ষিত হলেন। এই আর্থিক সুরক্ষা তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণে বা মালিক পক্ষের অন্যায্য সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে সাহস জোগাবে।
ভবিষ্য তহবিল (ধারা-২৬৪): ভবিষ্য তহবিল মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়ায় শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো।
সংক্ষেপে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বাধা হ্রাস এবং বিভিন্ন কল্যাণমূলক সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার কারণে শ্রমিকরা এখন আইনগত ও সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, যা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের পথকে মসৃণ করবে।


