৯ম পে স্কেল ২০২৫। কেউ বলছে অনুপাত নয়, ‘সমপরিমাণ যোগ’ নীতিতে বৈষম্য দূর করার দাবি
নবম জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর কাছে সরকারি কর্মচারীদের মতামত জানানোর সময় যখন শেষ হয়ে আসছে, তখন সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির প্রচলিত পদ্ধতি থেকে সরে এসে এক নতুন ও সরাসরি পদ্ধতির দাবি তুলে ধরেছেন। তাঁদের এই নতুন কৌশল সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত (যেমন ৪:১ বা ৮:১) নিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বেতনের অঙ্কে সমতা আনার ওপর জোর দিচ্ছে।
সরাসরি দাবি: অঙ্কের সমতা, অনুপাতের নয়
নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের এই নতুন দাবি অত্যন্ত স্পষ্ট:
“পে-স্কেলে বেতন গ্রেড-১-এ বর্তমানে যে টাকা যোগ হবে, সর্বশেষ গ্রেডেও সমপরিমাণ টাকা যোগ করতে হবে।”
তাঁদের যুক্তি হলো, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় সবার জন্য সমানভাবে বেড়েছে। তাই, সর্বোচ্চ গ্রেডের বেতন বৃদ্ধির জন্য যে মোট টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, সেই একই অঙ্কের টাকা সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতনের সঙ্গে যোগ করলে বৈষম্য কমবে এবং সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা সরাসরি উপকৃত হবেন।
উদাহরণ দিয়ে দাবির ব্যাখ্যা
কর্মচারীরা তাদের দাবির সপক্ষে একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন:
১. ধরি, নতুন পে স্কেলে গ্রেড-১-এর মূল বেতন ৭৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১,০০,০০০ টাকা (কাল্পনিক) করা হলো।
২. এক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে: ১,০০,০০০ – ৭৮,০০০ = ২২,০০০ টাকা।
৩. কর্মচারীদের দাবি, এই ২২,০০০ টাকা সরাসরি সর্বশেষ গ্রেড, অর্থাৎ ২০তম গ্রেডের বর্তমান মূল বেতনের সঙ্গে যোগ করা হোক।
৪. অর্থাৎ, ২০তম গ্রেডের নতুন শুরুর বেতন হবে: ৮,২৫০ + ২২,০০০ = ৳৩০,২৫০/-।
কৌশলগত সুবিধা কী?
এই ‘সমপরিমাণ যোগ’ (Equal Absolute Increment) নীতির প্রধান কৌশলগত সুবিধা হলো:
- দ্রুত বৈষম্য হ্রাস: এতে সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে একটি পরিবার চালানোর জন্য অপরিহার্য।
- সহজ হিসাব: অনুপাত, গ্রেড সংখ্যা বা গ্রেডের বিভাজন নিয়ে জটিল হিসাবের দরকার পড়বে না।
- উচ্চ গ্রেডের লাভ অক্ষুণ্ণ: উচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধিও নিশ্চিত হলো, কিন্তু নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরাও সরাসরি উপকৃত হলেন।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আনুপাতিক বৃদ্ধির (Percentage Based Increment) তুলনায় সমপরিমাণ বৃদ্ধির এই দাবিটি সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে এবং বৈষম্য কমাতে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। বিশেষত, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে এই ধরনের সরাসরি অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। তবে, এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে সরকারের ওপর বেতন বাবদ মোট ব্যয়ভার কতটা বাড়বে, তা বিশ্লেষণ করাও জরুরি।
জাতীয় বেতন কমিশনকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা প্রচলিত আনুপাতিক পদ্ধতির মাধ্যমে বেতন বৃদ্ধি করবেন, নাকি বৈষম্য নিরসনের জন্য ‘সমপরিমাণ যোগ’-এর মতো নতুন এবং সরাসরি পদ্ধতিকে বিবেচনা করবেন। কর্মচারীদের এই দাবি ১৫ অক্টোবর, ২০২৫-এর মধ্যে কমিশনের ওয়েবসাইটে (paycommission2025.gov.bd) জোরালোভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
যদি আপনার মনে হয় ‘সমপরিমাণ যোগ’ নীতি একটি ন্যায্য সমাধান, তবে জাতীয় বেতন কমিশন, ২০২৫-এর অনলাইন মতামত পোর্টালে (paycommission2025.gov.bd) এই যুক্তিটি জোরালোভাবে তুলে ধরুন।
গ্রেড ব্যবধান সমান হওয়া জরুরি?
হ্যাঁ, গ্রেডগুলোর মধ্যে পার্থক্য (ব্যবধান) একটি যৌক্তিক হারে সমান হওয়া জরুরি, কিন্তু সেটি শুধু টাকার অঙ্কে নয়, আনুপাতিক হারেও হওয়া উচিত।
১. গ্রেড ব্যবধানের বর্তমান সমস্যা
বর্তমানে (২০১৫ পে স্কেল অনুযায়ী) ২০টি গ্রেড রয়েছে। এই গ্রেডগুলোর মধ্যে টাকার অঙ্কে ব্যবধান সমান নয়, এবং এটিই মূল বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে।
- নিম্ন গ্রেড: গ্রেড-২০ থেকে গ্রেড-১৫ পর্যন্ত বেতনের পার্থক্য খুবই সামান্য। এই সামান্য পার্থক্য কর্মচারীদের কাজে উৎসাহিত করে না এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করে না।
- উচ্চ গ্রেড: গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-১ পর্যন্ত বেতনের পার্থক্য অনেক বেশি। এর ফলে উচ্চ পদে দ্রুত ও বেশি পরিমাণে বেতন বাড়ে, কিন্তু নিম্ন গ্রেডগুলো পিছিয়ে থাকে।
২. কেন সমান বা যৌক্তিক ব্যবধান জরুরি?
গ্রেডগুলোর মধ্যে একটি যৌক্তিক বা সুষম ব্যবধান থাকলে নিম্নলিখিত সুবিধাগুলো পাওয়া যায়:
৩. আপনার দাবি ‘সমপরিমাণ যোগ’-এর সাথে সম্পর্ক
আপনি যে ‘সমপরিমাণ যোগ’ নীতিটির কথা বলেছেন, সেটি এই গ্রেড ব্যবধানের সমস্যার একটি সরাসরি সমাধান দিতে পারে। যদি গ্রেড-১-এ যে টাকা যোগ হচ্ছে, সেই একই অঙ্কের টাকা গ্রেড-২০-এ যোগ করা হয়, তবে টাকার অঙ্কে সরাসরি লাভ হওয়ায় নিম্ন গ্রেডের বৈষম্য কমবে। তবে, কৌশলগতভাবে, কমিশন সাধারণত আনুপাতিক বৃদ্ধি (Percentage based)-এর দিকেই যায়।
আপনার দাবিটি কমিশনের কাছে কৌশলগতভাবে শক্তিশালী হবে যদি আপনি বলেন, প্রতিটি গ্রেডের মধ্যে একটি সুষম আনুপাতিক পার্থক্য (যেমন: গ্রেড-২০ থেকে গ্রেড-১৯-এ যেতে ন্যূনতম ১৫% বৃদ্ধি) বজায় রাখতে হবে।
সুতরাং, গ্রেড ব্যবধান অবশ্যই সুষম বা যৌক্তিক হওয়া জরুরি। এটি বেতন কাঠামোতে গতিশীলতা আনে এবং বৈষম্য কমায়। এই দাবিটিও কমিশনের অনলাইন মতামতে জোর দিয়ে তুলে ধরা উচিত।

